সময়ের মূল্য ও হায়াতের বরকতের আমল - সুরা আসরের তাফসির
সময়ের মূল্য ও হায়াতের বরকতের আমল
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيمِ وَالْعَصْرِ
কসম
যুগের (সময়ের),
إِنَّ الْإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ
নিশ্চয়
মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত;
إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ
কিন্তু
তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকীদ করে সত্যের এবং
তাকীদ করে সবরের।
আল্লাহ তাআলা বলেন: সময়ের কসম! নিশ্চয়ই সব মানুষ ক্ষতির মধ্যে আছে। কিন্তু তারা
নয় যারা ঈমান এনেছে, ভালো কাজ করেছে, একে অপরকে সত্যের পথে চলার উপদেশ দিয়েছে
এবং ধৈর্য ধারণ করার নসিহত করেছে। (সূরা আল-আসর: ১-৩)
সময়ের শপথ করার কারণ- বরফ বিক্রেতার মুলধন
সময়ের গুরুত্ব বুঝাতে আল্লাহ সময়ের শপথ করেছেন, ইমাম রাজি
বলেন আমি সুরা আসরের তাফসির ও তখন বুঝেছি যখন একজন বরফ বিক্রেতা তার বরফ বিক্রী
করার সময় চিৎকার করে করে বলছিল আসুন আমার বরফ কিনে নিন আমাকে লোকসান থেকে রক্ষা
করুন, না হয় আমার মুলধন নষ্ট হয়ে যাবে। বরফ বিক্রেতার বরফ গলে গেলে যেমন তার
মুলধনই শেষ তেমনি আমাদের জীবন থেকে সময় বরফের মত গলে গলে চলে যাচ্ছে, এই সময়টাই হল
আমাদের জীবনের মুলধন।
সময়ের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য আল্লাহ কুরানের অনেক
স্থানে বিভিন্ন সময়ের শপথ করেন- যেমন
১. সূরা আল-ফজর (আয়াত ১-৫):
وَالْفَجْرِ وَلَيَالٍ
عَشْرٍ وَالشَّفْعِ
وَالْوَتْرِ وَاللَّيْلِ
إِذَا يَسْرِ
هَلْ فِي ذَٰلِكَ
قَسَمٌ لِذِي حِجْرٍ
“শপথ ফজরের, আর দশ
রাত্রির, আর জোড় ও বিজোড়ের,
আর রাতের, যখন তা বিদায় নেয়।” (সূরা আল-ফজর, আয়াত ১-৪)
২. সূরা আদ-দুহা (আয়াত ১-২):
وَالضُّحَىٰ وَاللَّيْلِ
إِذَا سَجَىٰ
“শপথ সকালবেলার, এবং
রাতের, যখন তা নিস্তব্ধ হয়ে যায়।” (সূরা
আদ-দুহা, আয়াত ১-২)
৩. সূরা আল-আস্র (পুরো সূরা):
وَالْعَصْرِ إِنَّ
الْإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ
“শপথ সময়ের, মানুষ
অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত, (সূরা আল-আস্র)
৪. সূরা আল-লাইল (আয়াত ১-৩):
وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشَىٰ
وَالنَّهَارِ إِذَا
تَجَلَّىٰ
“শপথ রাত্রির, যখন তা
আচ্ছন্ন করে, এবং দিনের, যখন তা উদিত
হয়, (সূরা আল-লাইল, আয়াত ১-৩)
৫. সূরা আশ্-শামস (আয়াত ১-৪):
وَالشَّمْسِ وَضُحَاهَا
وَالْقَمَرِ إِذَا تَلَاهَا
وَالنَّهَارِ إِذَا
جَلَّاهَا وَاللَّيْلِ
إِذَا يَغْشَاهَا
“শপথ সূর্যের ও তার সকালে আলো ছড়ানোর,এবং চাঁদের, যখন তা সূর্যের অনুসরণ করে,এবং দিনের, যখন তা সূর্যকে প্রকাশ করে,এবং রাতের, যখন তা সূর্যকে আচ্ছাদিত করে।”
(সূরা আশ্-শামস, আয়াত ১-৪)
সময়কে কখনো অভিশাপ দেওয়া উচিত নয়।
কারণ স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা নিজেই 'আদ-দাহার' অর্থাৎ, তিনিই
সময়। তাই, সময়কে
খারাপ বলা বা সময়ের দোষ দেওয়া থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। এটি আসলে আল্লাহর
একটি বিশেষ গুণ। আমরা যেন কখনো না বলি, "আজ একটা খারাপ দিন ছিল" অথবা
"এই বছরটা খুব বাজে গেছে"। রাসূলুল্লাহ (সা.) স্পষ্টভাবে এমন কথা বলতে
নিষেধ করেছেন।
সময়ের শপথ ও মানবজাতির ক্ষতি
সূরা আল-আসরে আল্লাহ সময়ের কসম করে বলেছেন যে, "ইন্নাল
ইনসানা লাফি খুসর" অর্থাৎ, "নিশ্চয়ই মানুষ চরম ক্ষতির মধ্যে ডুবে
আছে।" এর অর্থ হলো, সময় নিজেই মানুষের ক্ষতির প্রমাণ।
মানুষ প্রতিনিয়ত কী হারাচ্ছে? সময়! এটি এমন এক সম্পদ যা আমরা কখনোই ধরে রাখতে পারি না।
প্রতিটি ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ড
চলে যাচ্ছে এবং তা আর ফিরে আসে না। সময় এমন কিছু নয় যা আপনি সঞ্চয় করে রাখবেন
এবং পরে প্রয়োজনমতো ব্যবহার করবেন। আমরা জীবনের অনেক সময় ইতিমধ্যেই হারিয়ে
ফেলেছি। অতীতে আমাদের অনেক সুযোগ ছিল যা আমরা কাজে লাগাইনি, সময়কে
ভালোভাবে ব্যবহার করিনি। তাই, সময়ের জন্য আফসোস আমরা হয়তো ইতিমধ্যেই করেছি। তবে এই
আফসোস থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর দিকে মনোযোগ দিতে
হবে।
আল্লাহ তায়ালা মানুষের ক্ষতির বিষয়টি সময়ের
সাথে জুড়ে দিয়েছেন,
কারণ সময় নিজেই এই ক্ষতির প্রমাণ।
গত ১
বছর কিভাবে কাটালাম? হিসাব করেছি?
সময় যেন দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু
আমরা তার মূল্য বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে, সময় থেকে যেন বরকত উঠে গেছে। মাস, দিন, বছর চোখের
পলকে কেটে যাচ্ছে। আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, গত এক বছরে আমরা এমন কী কাজ করেছি
যা দেশ, জাতি
বা ইসলামের উপকারে এসেছে?
গতকালের দিনটিই বা আমরা কীভাবে কাটিয়েছি, যা আমাদের মৃত্যুর পর কাজে আসবে? দুঃখজনক
হলেও সত্যি, আমরা
হয়তো এর কোনো উত্তর খুঁজে পাব না। এভাবেই আমাদের দিনগুলো কেটে যাচ্ছে।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, "ওয়াল আসর, ইন্না
ইনসানা লাফি খুসর।" অর্থাৎ, "সময়ের শপথ! নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে
নিমজ্জিত।" এই আয়াতটি প্রমাণ করে যে, মানুষ কীভাবে সময় নষ্ট করে ক্ষতির
মধ্যে পতিত হচ্ছে। সময়ের এই বরকতহীনতার মূল কারণ কী এবং কীভাবে আমরা আমাদের সময়ে
বরকত ফিরিয়ে আনতে পারি,
তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
নবী-সাহাবী ও সালফে
সালেহীনদের সময়ের মূল্য
নবী-সাহাবী এবং সালফে সালেহীনরা কীভাবে সময়কে
কাজে লাগিয়েছেন, তা
আমাদের জন্য এক বিরাট দৃষ্টান্ত। তাঁদের জীবনে সময়ের যে অসাধারণ বরকত ছিল, তা সত্যিই
অবিশ্বাস্য। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) মাত্র ২৩ বছরের নবুওয়াতী জীবনে
সারা পৃথিবীতে এক মহাবিপ্লব ঘটিয়েছেন। আর আমরা ৩০-৪০ বছর বয়সেও তেমন কিছুই করতে
পারি না।
ইমাম নববী (রহ.) মাত্র ৩৭-৩৮ বছর
বয়সে ইন্তেকাল করেন, অথচ
তাঁর এমন কোনো কিতাব নেই যা মুসলিম উম্মাহর ঘরে স্থান পায়নি। আল্লাহ তাঁদের সময়ে
অসাধারণ বরকত দিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের সময়গুলো বরকতহীন।
ইমাম বুখারীর উস্তাদ:
৩০ বছর নিজ হাতে খাবার খান নাই, তিনি বলেন আমি হাদিস লিখতাম আর আমার বোন আমাকে
কাইয়ে দিত।
দিন প্রতিদিন কি বলে?
প্রতিদিন দিন বলে আমি আজ এসছি আজকের পর আমি আর
ফিরে আসবনা, তাই তোমরা আমার সৎব্যবহার করে নাও। ১লা মহররম ১৪৪৭ হিজরী এটি আর ফির
আসবেনা।
সময় বাঁচাতে শিখতে হবে নবীর জীবন
থেকে:
আমার নবী জীবনে ২৭ টি যুদ্ধ করেছেন কিন্তু তবুও
আমার নবীর জীন্দেগীতে একটি নামাজ কাজা হয়নি, আমার নবী তবুও নিজের স্ত্রীদের হকের
মধ্যে অবহেলা করেননি, নবীজি অন্যান্য যে সকল কাজ করতেন কোন কাজেই অবহেলা হয়নি,
এমননি আমার নবীজির তাহাজ্জুদের মধ্যেও কোনদিন এফেক্ট পরে নাই। তাই রব ডাক দিয়ে
বলেন (এয়া আইয়্যুহাল মুজ্জামিল) হে চাদর জড়ানো মাহবুব সারা রাত জাগার দরকার নাই
অল্প জাগ বাকী অংশে বিশ্রাম কর।
হারুন রশিদ ও সুইওয়ালা
খলিয়া হারুন রশিদ একবার এলান করলেন আমার রাজ্যের
যারা নতুন নতুন টেলেন্ট দেখাতে পারবে তাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে। অনেকে অনেক
টেলেন্ট দেখালেন তাদের মধ্যে একজন এমন একটি টেলেন্ট দেখালো যা দেখে সকলেই অবাক
হলেন, বাদশাও অবাক, তার টেলেন্ট ছিল সে একটি
সুইকে জমিনে গেড়ে দিল আর দুরে দাঁড়িয়ে সে সুই এর যে ছিদ্র সে ছিদ্রের ভিতর দিয়ে
দুর থেকে নিক্ষেপ করে অন্য একটি সুই ঢুকাতে পারে, এই দৃশ্য
দেখে বাদশা তাকে পুরস্কার দিলেন সাথে সাথে তাকে ১০টি কোরা মারার নির্দেশ দেন,
এর কারন হিসেবে বলেন সে অনেক পরিশ্রমি, অনেক
কষ্ট করে সে এই টেলেন্ট অজন করেছে তাই তাকে পুরস্কার দিয়েছি, কিন্ত সে এত পরিশ্রম করে এমন একটি টেলেন্ট অজন করল যার দুনিয়াবি কোন
ফায়দাও নাই আখেরাতের কোন ফায়দাও নাই, তাই তাকে শাস্তিও
দিলাম।
আমাদের সময় যেন এমন কোন কিছুর পিছনে ব্যয় না হয়
যা আমাদের দুনিয়াতেও কোন ফায়দা দিবেনা আখেরাতেও কোন ফায়দা দিবেনা।
সময়ে বরকত লাভের উপায়
সময়ে বরকত ফিরিয়ে আনার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ
কাজ রয়েছে:
১. আল্লাহকে স্মরণ করা (জিকির): সময়ে বরকত লাভের জন্য আল্লাহ
সুবহানাহু তায়ালাকে স্মরণ করা বা তাঁর জিকির করা অত্যন্ত জরুরি।
যেমন ইউনুস (আ) এর ঘটনা
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, যদি ইউনুস
(আ.) মাছের পেটে তাঁকে স্মরণ না করতেন, তাহলে কিয়ামত পর্যন্ত তিনি মাছের
পেটে থেকে যেতেন। আল্লাহ আরও বলেছেন, "ফাযকুরুনী আযকুরকুম" অর্থাৎ, "তোমরা
আমাকে স্মরণ করো, আমি
তোমাদের স্মরণ করব।" আপনি পৃথিবীর যেখানেই থাকুন না কেন, যখনই
আল্লাহকে স্মরণ করবেন,
তিনি আপনাকে স্মরণ করবেন।
যে সব বৈঠক সভা সমাবেশ মৃত গাধা
ভোজনের মত
সূত্র: আবু দাউদ
৪৮৫৫
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:
مَا مِنْ قَوْمٍ يَقُومُونَ مِنْ مَجْلِسٍ
কোনো কওম (দল) যদি কোনো সমাবেশ থেকে উঠে যায়,
لَا يَذْكُرُونَ اللَّهَ فِيهِ،
যেখানে তারা আল্লাহকে স্মরণ করেনি,
إِلَّا قَامُوا عَنْ مِثْلِ جِيفَةِ حِمَارٍ،
তবে তারা যেন গাধার মৃতদেহ থেকে উঠে গেল,
وَكَانَ لَهُمْ حَسْرَةً
এটি তাদের জন্য পরিতাপের কারণ হয়ে থাকবে।
সুতরাং আমদের প্রতিটি কাজ হতে হবে আল্লাহর
স্মরনে, আল্লাহর
সন্তুষ্টির জন্য, কোন
বৈঠক করার পর সবশেষে দোয়া করবেন, আলোচনা করলে তার শুরুতে কোরআন তেলাওয়াত করবেন। অন্যথায় সব
বৈঠক সব আলোচনা হবে মৃত গাধা ভোজনের মত।
ইবনে তাইমিয়া (রহ.) ফজরের পর থেকে
সকাল ৮-১০টা পর্যন্ত একাকী আল্লাহর জিকির করতেন। ইবনুল
কাইয়িম (রহ.) একদিন তাঁকে সকালের নাস্তার কথা বললে তিনি উত্তর দেন, "এটাই ছিল
আমার সকালের নাস্তা। ফজরের পর যদি এই ২-৩ ঘণ্টা আল্লাহকে স্মরণ না করতাম, তাহলে আমার
পেট, আমার
অন্তর, আমার
আত্মা পরিপূর্ণ হতো না এবং সারাদিন আমি কোনো শান্তি পেতাম না।"
আত্মার খোরাক হল জিকির
আমাদের আত্মাকে সতেজ রাখতে জিকির অপরিহার্য।
মানুষ যেমন খাবারের মাধ্যমে শারীরিক পুষ্টি লাভ করে, তেমনি আত্মার খাবার হলো আল্লাহর
জিকির। আত্মা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, তাই যখন তাকে আল্লাহ থেকে দূরে রাখা
হয়, তখন
সে অশান্ত থাকে। যখনই আমরা গুনাহ করি, তখনই আমরা আমাদের আত্মার উপর জুলুম
করি, কারণ
আত্মা তার প্রতিপালক থেকে দূরে সরে যায়। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া হাজার
গুণ কষ্টের। আমাদের প্রত্যেকের আত্মা কষ্ট অনুভব করে, কিন্তু
আমরা তা বুঝতে পারি না। আমরা গান, ব্যস্ততা, খেলাধুলা বা মোবাইলের মাধ্যমে নিজেদেরকে ভুলিয়ে রাখি। অথচ
আত্মার প্রশান্তি কেবল আল্লাহর জিকিরেই নিহিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, "আলা বি জিকরিল্লাহি তাতমাইন্নুল কুলুব" অর্থাৎ, "জেনে রাখো, আল্লাহর
স্মরণেই অন্তরসমূহ প্রশান্তি লাভ করে।"
২. নামাজ: সর্বোত্তম মেডিটেশন: আমরা যদি জীবনে শান্তি ও সময়ের
বরকত চাই, তাহলে
প্রতিদিন আল্লাহর স্মরণের জন্য সময় বের করতে হবে। অন্ততপক্ষে, দিনে রাতে
পাঁচবার নামাজের মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করা আবশ্যক। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, "সালাত
কায়েম করো আমাকে স্মরণ করার জন্য।"
বর্তমান যুগে মানুষ মেডিটেশনের মাধ্যমে আত্মিক
শান্তি খোঁজে। কিন্তু নামাজের চেয়ে বড় কোনো মেডিটেশন পৃথিবীতে নেই। সালাতের
সর্বোচ্চ স্তর হলো কাজ করা অবস্থায় ধ্যান করা, আর নামাজে আমরা রুকু-সিজদার মতো কাজ
করার পাশাপাশি পরিপূর্ণ মনোযোগ আল্লাহর প্রতি নিবদ্ধ রাখি। মনোযোগ দিয়ে সালাত
আদায় করলে আপনার অন্তর শান্ত হবেই, জীবনে শান্তি ফিরে আসবে এবং সময়ে
বরকত হবেই।
৩. কোরআন তেলাওয়াত: আপনার সময় বরকত ফিরিয়ে আনার
দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো কোরআন তেলাওয়াত করা। পৃথিবীর কোনো স্কলার বা খতিবের হাজারো
বক্তব্য যত মানুষকে হেদায়েত করতে পারবে, একটি কোরআন তার চেয়ে বেশি মানুষকে
হেদায়েত করতে পারবে। কারণ কোরআনকে আল্লাহ তায়ালা "হুদাল্লিন্নাস"
(মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক) বলেছেন। কোরআন বোঝার ক্ষমতা অর্জন করা আমাদের
সকলের জন্য ফরজ। কারণ যদি আমরা কোরআন না বুঝি, তাহলে আল্লাহ আমাদের জন্য কী বার্তা
পাঠিয়েছেন, তা
আমরা বুঝতে পারব না। বুঝে কোরআন তেলাওয়াত করলে চোখে পানি আসবে এবং অন্তর শান্ত
হবে।
সময়ের বরকত ছিনতাই কারী
আসামী: মোবাইল ফোন
আমাদের এই যুগে সময় থেকে বরকত কেড়ে নেওয়ার
সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো হাতে থাকা মোবাইল ফোন। একবার
ফোন হাতে নিলে কখন ৩০ মিনিট বা ১ ঘণ্টা পেরিয়ে যায়, তা আমরা
টেরই পাই না। বিজ্ঞানীরা মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করে এমনভাবে অ্যাপ্লিকেশনগুলো
তৈরি করেছে, যা
মানুষের আত্মাকে আকৃষ্ট করে রাখে। লাইক, শেয়ার, লাভ, হেট, রাগ, হাসি – এই
অপশনগুলো ব্যবহার করে তারা ২৪ ঘণ্টা গবেষণা করে যে কীভাবে মানুষকে আরও বেশি আসক্ত
করা যায়। ফেসবুক, ইউটিউবসহ
এই মোবাইল আমাদের সময়ের বরকত কেড়ে নিয়েছে।
যদি আপনি জীবনে শান্তি ও সময়ের মূল্য ফিরিয়ে
পেতে চান, তাহলে
মোবাইলের ব্যবহারে কিছু নিয়ম মেনে চলা জরুরি:
১. ঘুম থেকে উঠে মোবাইল নয়: ঘুম থেকে উঠেই মোবাইল হাতে নেবেন
না। ঘুম থেকে ওঠার দোয়া পড়ে, অজু করে, ফজরের সালাত আদায় করে এবং কোরআন তেলাওয়াত করার পর মোবাইল
হাতে নিন।
২. ঘুমানোর আগে মোবাইল ত্যাগ করুন: ঘুমানোর অন্তত আধা ঘণ্টা বা এক
ঘণ্টা আগে মোবাইল দূরে সরিয়ে রাখুন। কোরআন তেলাওয়াত করে, দোয়া-দরুদ
পড়ে ঘুমানোর অভ্যাস করুন। ঘুমকে ইবাদতে পরিণত করুন, যেন ঘুমের মধ্যেও আপনার আমলনামায়
নেকি লেখা হয়। অজু করে ঘুমের দোয়া পড়ে ঘুমালে এবং রাতে ঘুম ভাঙার পর আল্লাহকে
স্মরণ করে কিছু চাইলে,
আল্লাহ তা পূরণ করে দেন।
দোয়া পড়ে ঘুমানোর পর মারা গেলে?
যদি দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে ঘুমান তাহলে সে ঘুমে
যদি মারা যান তাদের জন্য বিরাট সুখবর মুসলিম শরীফের ২৮৭৮ নং হাদিসের বর্ণনা- নবী করিম (দ) এরশাদ করেন-
" يُبْعَثُ كُلُّ عَبْدٍ عَلَى مَا مَاتَ عَلَيْهِ "
প্রত্যেক বান্দা কিয়ামতের দিন ঐ অবস্থায়
পুনরুথিত হবে, যে অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করল।
ঘুমানোর সময় কি পড়বেন?
যদি সকল ক্লান্তি দুর করতে চান:
তাসবিহে ফাতেমি পড়বেন
যদি জান্নাতে বালাখানা বানাতে চান: ১০
বার সুরা ইখলাস পড়বেন
যদি ১ খতম কোরানের নেকি চান: ৩ বার সুরা ইখলাস পড়বেন।
যদি সারা রাত ফেরেশতার নিরাপত্তা চান: ১ বার আয়াতুল কুরসি পড়বেন
যদি ১০০০ নেকি ও ১০০০ গুনাহ মাফা চান: ১০০ বার সুবহানাল্লাহ পড়বেন (মুসলিম ২৬৯৮)
সুন্দর দোয়াটি পড়বেন:
"بِاسْمِكَ رَبِّـي وَبِكَ وَضَعْتُ جَنْبِي وَبِكَ أَرْفَعُهُ، إِنْ أَمْسَكْتَ نَفْسِي فَاغْفِرْ لَهَا، وَإِنْ أَرْسَلْتَهَا فَاحْفَظْهَا بِمَا تَحْفَظُ بِهِ عِبَادَكَ الصَّالِحِينَ"
এর বাংলা অনুবাদ:
“হে আমার প্রতিপালক! তোমার নামে আমি আমার শরীর বিছানায় রাখি এবং
তোমারই নামে তা উঠাই। যদি তুমি আমার প্রাণ কেড়ে নাও, তবে
তাকে ক্ষমা করে দিও। আর যদি প্রাণ ফিরিয়ে দাও, তবে তাকে
রক্ষা কর, যেমন তুমি তোমার সৎকর্মশীল বান্দাদের রক্ষা কর।”
এই সুন্দর সুন্দর আমলগুলি করে
যদি ঘুমান আর তার মধ্যেই যদি আপনার মৃত্যু হয় তাহলে আপনি এবাদতকারী হিসেবে হাশরের
মাঠে উঠবেন।
কিন্তু যদি আপনি হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে
ঘুমান?
যারা গান শুনে শুনে ঘুমান তাদের জন্য
দুঃসংবাদ
সূত্র: আবু দাউদ
৪৮৫৬
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ:
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি
বলেছেনঃ
مَنْ قَعَدَ مَقْعَدًا لَمْ يَذْكُرِ اللَّهَ فِيهِ،
যে ব্যক্তি কোনো স্থানে বসে এবং সেখানে আল্লাহকে স্মরণ করে না,
كَانَتْ عَلَيْهِ مِنَ اللَّهِ تِرَةٌ،
তার ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ক্ষতি (লাঞ্ছনা) হয়,
وَمَنْ اضْطَجَعَ مَضْجَعًا، لَا يَذْكُرُ اللَّهَ فِيهِ،
আর যে ব্যক্তি কোনো শয্যায় শোয় এবং সেখানে আল্লাহকে স্মরণ করে না,
كَانَتْ عَلَيْهِ مِنَ اللَّهِ تِرَةٌ
তার ওপরও আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ক্ষতি (লাঞ্ছনা) হয়।
৪) সময়ে বরকত লাভের জন্য সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠা
সকালবেলার সময় বরকতের উৎস
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, (তিরমিজি
১২১২)
"اللهم بارك لأمتي في بكورها"
"আল্লাহ আমার উম্মতের জন্য সকালে
বরকত রেখেছেন।"
এটি কেবল একটি হাদিস নয়,
বরং সফলতার এক মূলমন্ত্র। বিশ্বের অধিকাংশ সফল ব্যক্তিরা সকালে ঘুম থেকে ওঠেন
এবং দিনের শুরুতে কাজ শুরু করেন। অথচ, আমাদের মুসলিম যুবসমাজ ও ছাত্ররা
রাত জেগে মোবাইল বা অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় নষ্ট করে, ফজরের সময়
ঘুমাতে যায় এবং দিনের সবচেয়ে বরকতময় সময়টায় ঘুমিয়ে কাটায়।
৫) যে কোন কাজ শুরু করার আগে বিসমিল্লাহ বলা-যে
কাজে বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু হয়, তাতে শয়তানের হস্তক্ষেপ কমে,
ফলে সময় নষ্ট হয় কম
৬) সময়সূচি/রুটিন তৈরি করা ও অগ্রাধিকার ঠিক করা
জরুরী (Urgent) ও গুরুত্বপূর্ণ (Important) এর পার্থক্য বুঝুন: মানুষ
সর্বদা "জরুরী" বিষয়ের পেছনে ছুটে। আমাদের ভাবতে হবে, কোনটি
আসলেই "গুরুত্বপূর্ণ" এবং কোনটি আমার জন্য উপকারী। যদি কোনো কাজ
গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবেই
সেটি করুন। অন্যথায়,
সেটিকে পরে করার জন্য রেখে দিন। কেবল "আর্জেন্ট" বিষয়ের পেছনে
ছুটলে আপনি আপনার সময়ের বরকত হারিয়ে ফেলবেন। প্রতিটি পদক্ষেপে আপনাকে ভাবতে হবে, এই কাজটি
আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী কিনা।
৭) ফালতু কাজ ও গসিপ থেকে দূরে থাকা
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: "ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্যের একটি দিক
হল— যা তার জন্য প্রয়োজন নেই, তা থেকে
নিজেকে বিরত রাখা।" (তিরমিযি ২৩১৭)
৮. নিয়ত ও কাজকে ইখলাস (আল্লাহর জন্য খাঁটি) করা
একেই বলে: "নিয়তের বরকত"।একজন
মানুষ স্বল্প সময়ে অনেক কাজ করতে পারে যদি তার নিয়ত হয় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
৯. পরিশ্রম + দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ সময় নষ্ট হয় যখন আমরা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ
করতে পারি না— ঘুম, মোবাইল, খাওয়া, মেজাজ।
১০) দোআ করা বরকতের জন্যদোআ:
"اللَّهُمَّ
بارِكْ لي في
وقتي، وأعنّي على
ذِكْرِك وشُكْرِك وحُسْنِ
عبادتك"
“হে আল্লাহ! আমার সময়ের মধ্যে বরকত দাও
এবং তোমার যিকির, শোকর ও সুন্দর ইবাদতের জন্য আমাকে সাহায্য কর।”
আমাদের জীবনে সময়ের এই অভাবনীয় বরকত ফিরিয়ে
আনতে হলে উল্লেখিত বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা
একান্ত প্রয়োজন।
কিয়ামতে আপনার ৮০ বছরের জীবনকে ১ দিন
বা ১ রাত কেন দেখা যাবে?
কিয়ামতের দিন মানুষ দেখবে যে, তারা
পৃথিবীতে যেন মাত্র এক রাত,
এক সকাল বা একদিন বসবাস করেছে। এর কারণ, জীবনের ৮০ বছর বা তারও বেশি সময়
পার করলেও, যে
সময়টুকু আল্লাহর পথে কাজে লাগানো হয়নি, তা সেদিন হিসাবে আসবে না। কেবল সেই
অংশটুকুই গণনা করা হবে যা সৎকর্মে ব্যয় হয়েছে।
সময় সম্পর্কে কিছু
গুরুত্বপূর্ণ বাণী
১) বুখারীর ৬৪১২ নং হাদিসের বণনা
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ
قَالَ
قَالَ
النَّبِيُّ
صلى
الله
عليه
وسلم
نِعْمَتَانِ
مَغْبُونٌ
فِيهِمَا
كَثِيرٌ
مِنْ
النَّاسِ
الصِّحَّةُ
وَالْفَرَاغُ
রাসূলুল্লাহ (সা.) দুটি নেয়ামত সম্পর্কে বিশেষভাবে সতর্ক
করেছেন, যা
নিয়ে মানুষ সবচেয়ে বেশি উদাসীন: সুস্বাস্থ্য
এবং
অবসর সময়।
২) ইমাম শাফি' (রহ.) বলেন:
"সময় তরবারির মতো, তুমি যদি একে না কাটো,
তবে সে তোমাকে কেটে ফেলবে।"
৩) "সময়ই একমাত্র সম্পদ,
যা একবার হারালে
আর ফেরত আসে না।"
৪) "সময় কারো জন্য থেমে থাকে না, তবে যে সময়কে ধরে রাখে,
সে-ই ইতিহাস গড়ে।"
৫) "যে সময়কে অবহেলা করে, ভবিষ্যত তাকে অশ্রু দিয়ে মূল্য
দিতে বাধ্য করে।"
শেষ কথা:
সময় এক অমূল্য সম্পদ, যা একবার চলে গেলে ফেরে না। বরকতময় জীবন গঠনের মূল চাবিকাঠি হলো— সময়কে আল্লাহর পথে ব্যবহার করা। বরকতের জন্য প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণ, ইখলাস, দোআ ও সৎ সঙ্গ। আসুন, নতুন
হিজরী বছরের শুরুতে আমরা সময়ের মূল্য অনুধাবন করি এবং বরকতময় হায়াতের দিকে এগিয়ে
যাই।
اللَّهُمَّ اجْعَلْ أَوَّلَ هَذَا الْعَامِ صَلَاحًا، وَأَوْسَطَهُ
فَلَاحًا، وَآخِرَهُ نَجَاحًا
“হে আল্লাহ! এই বছরের শুরুটা কর নেক আমলে, মাঝখানটা
কর কল্যাণে ভরা এবং শেষটা কর সফলতায়” আমিন।
কোন মন্তব্য নেই